Know to Conserve

 
All Post
 

বাংলাদেশে জীবৈচিত্রে যুক্ত হলো আর ও এক প্রজাতি, নাম তার “জার্ডনের-হরবোলা”


  গত  ১০জুলাই, ২০১৬ তারিখে  মেহেরপুর জেলার কাথুলি গ্রামের অন্তর্গত মেহেরপুর পৌর কলেজ প্রাঙ্গণে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম জার্ডনের-হরবোলা (Jerdon’s Leafbird) পাখিটির উপস্থিতি খুঁজে পান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্দালয়ের প্রাণিবিদ্যা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ৯ম ব্যাচ এর শিক্ষার্থী মোহাম্মদ  সালাহউদ্দিন।পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Chloropsis jerdoni । পাখিটি Passeriformes বর্গের অন্তর্গত Chloropsidae  গোত্রের বর্তমানে বাংলাদেশে তিন প্রজাতির হরবোলা পাখি পাওয়া যায় ( সোনাকপালি-হরবোলা, কমলাপেট-হরবোলা এবং নীলডানা-হরবোলা ) জার্ডনের-হরবোলা সাধারণত ১৯ সেন্টিমিটারের বেশি বড় হয় না, গায়ের রঙ  সবুজ, তবে প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে ও পুরুষ পাখিদের বুক ও পেট হালকা কমলা রঙের হয়। এদের কপাল কমলা রঙের হয় না এবং এদের ডানার দুই পার্শ্বে ও লেজের দুই প্রান্ত নীলচে রঙের হয় না অথবা খুব সামান্য পরিমাণ হয় যা দিয়ে অন্যান্য হরবোলা হতে জার্ডনের-হরবোলাকে সহজে শনাক্ত করা যায়। পুর্বে পাখিটি শুধুমাত্র ভারত এবং শ্রীলঙ্কাতেই পাওয়া যেত।

এ পর্যায়ে আমরা পাখিটি খুঁজে পাওয়া এবং এর শনাক্তকরণের পিছনের গল্প শুনবো  গবেষকের মুখ থেকে

 ১০জুলাই,২০১৬ ঈদের দিন, সকালটা বেশ চনমনে ছিল। আকাশে রোদের ঝিলিক। নামাজ শেষ করে যথারীতি প্রতিবারের মতই এবারও ক্যামেরা হাতে করে বের হয়ে গেলাম বন্ধুদের সাথে ঘুরতেপ্রথমে গেলাম আমঝুপি নীলকুঠিতে। ঘোরাঘুরির পাশাপাশি ছবি তোলা হল অনেক। নিজেদের ছবি তোলার মাঝে মাঝে দুই একটা পাখিরও ছবি নিলাম। আসলে পাখি দেখা আর ছবি তোলার নেশাটা ঈদের দিনও পিছু ছাড়েনি। দুপুর নাগাদ আমরা মেহেরপুর এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে বিকেলবেলা আমি আর আমার কিছু বন্ধুরা আমার কলেজ মেহেরপুর পৌর কলেজ এর দিকে পাড়ি দিলাম। বিশেষ কিছু বন্ধুদের সাথে দেখা করার কথা ছিল।

আমার কলেজটি মেহেরপুর শহরের উত্তর দিকে প্রায় ২.৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কলেজটির আয়তন তুলনামূলক কম হলেও পুরো প্রাঙ্গণ জুড়ে লাগান আছে বিভিন্ন ধরনের ফলজ, বনজ এবং ঔষধি গাছের সারি। এখানে হরেক রকমের দেশীয় প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। যেমন- শালিক, চড়ুই, টিয়া, বসন্ত-বাউরি, টুনটুনি, ঘুঘু, কাঠ-ঠোকরা, দোয়েল, কোকিল, বুলবুলি, পেঁচা আরও অন্যান্য পাখি। কলেজ প্রাঙ্গণের চতুর্দিকে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ফলের এবং বনজ গাছের বাগান। বাগানের ফাঁকে ফাঁকে হয় মৌসুম অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের চাষাবাদ ( ধান, পাট,গম,ভুট্টা ইত্যাদি) করা হয়

 

                       

                                                   ছবি: নতুন পাখি জার্ডনের-হরবোলা

কলেজে পৌঁছাইতে পৌঁছাইতে এক পশলা হালকা বৃষ্টি হয়ে গেল। ভিতরে ঢুকতেই শোনা গেল পাখিদের কলতান। বন্ধুদের সাথে কুশল বিনিময় করে প্রশাসনিক ভবনের শেষ প্রান্তের সিঁড়ির উপরে বসে কথা বলছিলাম। ঠিক সন্ধ্যা ৬.২০ বাজে এমন সময় আমার চোখ পাশে থাকা মোটাসোটা গগন-শিরিশ গাছের দিকে চোখ পড়লো।সবুজ রঙের একটা পাখিকে উড়ে এসে বসতে দেখলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম নীল-গলা বসন্তবাউরি। কিন্তু ওটার ঠোঁট আর গলার দিকের কালো রঙের জন্য কৌতূহল বেড়ে গেলো। আমার বন্ধু আশিক আর সুজন ক্যামেরা দিয়ে নিজেদের ছবি তুলছিল। আমি দ্রুত ওদের কছে থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে পাখিটার ছবি নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আলোর স্বল্পতার কারণে ফোকাস করতে পারছিলাম না। কোনরকম ৩ টা শট নেওয়ার আগেই উড়ে গেলো পাখিটা। ছবিগুলো ঠিকমতো ফোকাস নিয়েছিল না, কিন্তু দেখে বুঝলাম এটা যে কোনো এক প্রজাতির হরবোলা হবে। আমি মনে মনে ভাবতে থাকলাম যে, এখানে হরবোলা আসলো কোথাথেকে আর ওটাকে খুজতে থাকলাম। কারণ বাংলাদেশে যে তিন প্রজাতির হরবোলা আছে সেগুলো সাধারণত ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম, সুন্দরবনে এবং সর্ব  উত্তরের কিছু অঞ্চলে পাওয়া যায়। মিনিট পাঁচেক পরে আবারো খুঁজে পেলাম পাশেরই জগডুমুর গাছে। গায়ের রঙ দেখে বুঝলাম এটি একটি পুরুষ পাখি। পাখিটি খুবই লাজুক প্রকৃতির। একেতে আলোর স্বল্পতা ছিল তার ওপরে পাখিটা স্থির হচ্ছিলো না। যার কারণে ছবি তোলা অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো। তারপরও বেশকিছু ছবি নিতে সমর্থ হই। একটু পরেই গগণ-শিরিশ গাছটির দিকে তাকিয়ে দেখি একটি অপ্রাপ্ত বয়স্ক হরবোলা গাছের উপরের কোটরে জমে থাকা পানিতে গোসল করছে। এই ফাঁকে আমি কিছু ছবি তুলে একটা ভিডিও নেই। এবার অপ্রাপ্ত বয়স্ক পাখিটিকে পাহারা দেওয়া অবস্থায় তার মাকে খুঁজে পেলাম। হরবোলার পুরো পরিবারটিকে ক্যামেরাবন্দি করতে পেরে ভালই লাগলোমা পাখিটার ভালো ছবি নেওয়ার আগেই তারা সেখান থেকে চলে গেলো। প্রায় এক ঘণ্টা যাবৎ পাখিগুলোর গতিবিধি লক্ষ্য করছিলাম। কি আর করা আর অপেক্ষা করতে পারলাম না। আমার বন্ধু গুলো আমার উপরে রেগে আগুন। যার কারণে ছবি তোলা বাদ দিয়ে ওদের সাথে যোগ দিলাম। সে দিনের জন্য বার্ডিং এর  ইতি টানলাম।

ঢাকা ফিরে না আসা পর্যন্ত পাখিটা নিয়ে আর মাথা ঘামানো হয়নি। ঢাকা ফিরে এসেই আমি বাংলাদেশের পাখি  শনাক্তকারী ফেসবুক গ্রুপ Birds Bangladesh এবং ভারতের পাখি শনাক্তকারী ফেসবুক গ্রুপ Ask id’s of Indian Birds এ পাখিটির ছবি পোস্ট করি। উক্ত গ্রুপদ্বয় হতে কয়েকজন এটি Jerdon’s Leafbird বলে ধারণা প্রদান করেন। অপরদিকে এটির বিপক্ষেও অনেকে মন্তব্য করেন। আমি গুগুল এ সার্চ দিয়ে দেখলাম আমার পাওয়া পাখিটির সাথে জার্ডনের-হারবোলার সম্পূর্ণ মিল রয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু এঙ্গেলে ছবি না পাওয়ার দরুন এক্সপার্টদের শনাক্ত করতে অসুবিধা হচ্ছিলো। পরবর্তীতে আমি মোঃ শাহাদ রাজু ভাই এর কথা মতো পাখি গবেষক মোঃ সায়েম চৌধুরী ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ করি আর ওনাকে আরও কিছু ছবি ই-মেইল করে দেই। পাশাপাশি আমি বিশিষ্ট পাখি গবেষক পল থমসন স্যার কেও ই-মেইল করি।  প্রায় সাত দিন পর সায়েম ভাইয়া এবং পল থমসন স্যার উভয়ে ই-মেইল করে জানিয়ে দেন যে, এটা Jerdon’s Leafbird যা বাংলাদেশের জন্য নতুন পাখি। সাথে আরো বলেন ছবির ভালো এঙ্গেল ও রেজুলেশন না থাকার কারনে শনাক্তকরনে একটু দেরি হয়েছে। সেই সময়টাতে অনেক ভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছিল নিজেকে। মনে মনে আমি আল্লাহ্‌ তা’আলার কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম এবং আমার বিভাগের বড় ভাইয়াদের বিশেষ করে মোঃ ফয়সাল আহমেদ পিয়াস ও আমার খুব কাছের বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ স্বীকার করলাম। ওনারাই আমার অনুপ্রেরনা আর বন্ধুরা আমার শক্তি।

সে যায় হোক, পরবর্তী কোরবানির ঈদ ও তার মাস দুয়েক পরেও হরবোলা ত্রয় কে পেয়েছিলাম। কিন্তু  তারপরে ওদের আর দেখা পায় নি। ধরে নিলাম ওরা ভালো আছে, ঘুরছে গাছের এ ডাল থেকে ও ডালে, লুকোচুরি খেলছে পাতার ফাঁকে। হয়ত কোনো একদিন আবারো দেখা হবে ওদের সাথে অন্য কোনো জায়গায়, অন্য কোনো গাছের অন্য কোনো ডালে।  (লেখক, মোহাম্মদ  সালাহউদ্দিন).

 
Flag Counter